ব্যবসায়িক সূত্রে বাঁধার মধ্যে দিয়েই হামাস কে নিয়ন্ত্রনের বার্তা কাতার কে দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট?
By -Bhasha24
জুলাই ২৩, ২০২৫
0
দুবাই শহরটা বেড়ে উঠছে বেশ কিছু বছর হল। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী শহরটিকে গড়ে তুলছে অতি যত্নে, অতি দ্রুত গতিতে। মে মাসের 12 তারিখে কলকাতা থেকে নিউইয়র্কের যাত্রাপথে পা রাখলাম সেখানে। কলকাতা থেকে নিউইয়র্ক বহু দূরের পথ, তায় দুবাইয়ে বহু ঘন্টার লে ওভার। তাই ঢুকে পড়লাম দুবাই শহরে। আকাশ থেকে দেখতে পাওয়া যায় পারস্য উপসাগরের কোল ঘেঁষে পীতবর্ণ অপার মরুভূমি আর সেই মরুভূমির উপর নাগরিক ঐশ্বর্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার ও পরিকাঠামো ব্যবস্থার বহুবিধ সুবিধা নিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে এক বিশাল শহর। বন্ধ্যা, ঊষর মরুভূমির বুকে দুবাই শহরের অভিনব নক্সার বৈচিত্র্যময় ও সুবিশাল বিল্ডিংগুলি আধুনিক স্থাপত্যকলার অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন। যেন প্রভুর হুকুমে আলাদিনের প্রদীপের দৈত্য হাজির করেছে একের পর বিল্ডিং আর শহরটিকে করে তুলেছে আধুনিক স্থাপত্যের এক সুবিশাল কিউরিও শপ। দুবাইয়ের বিল্ডিংগুলি 'এ বলে আমায় দেখ্ আর ও বলে আমায়'। দাঁড়িয়ে আছে এতই গা ঘেঁষাঘেঁষি যে কোনো স্থাপত্যের চোখ-ধাঁধানো সৌন্দর্য্যই যেন ঠিক খুলছে না। অনেক সুন্দরকে একজায়গায় করলে প্রত্যেকেই কি কিঞ্চিৎ ম্লান হয়? কথায় বলে 'চাঁদের হাট'। কিন্তু বাস্তবপক্ষে চাঁদের হাট বসলে কি ভালো হত? কিন্তু সেসব কথা থাক্। গুরুত্বপূর্ণ হল— দুবাই গড়ে উঠেছে নাগরিক সভ্যতার সুযোগ সুবিধার ব্যাপকতা বিশ্বের ধনী মানুষদের হাতে তুলে দিয়ে শহরটিকে আরও বর্ধিষ্ণু করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়েই।
এ শহরে পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী সমুদ্রসৈকতগুলিও নাগরিক বৈভবে পরিপূর্ণ ও সুন্দর। জুমেইরা বিচ বা পাম জুমেইরা বিচ সুন্দর ও বিলাসবহুল। বিলাস ও বৈভব উদযাপনেরই শহর এই দুবাই। অসংখ্য উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলির মধ্যে উচ্চতম বিল্ডিং’টি হল 'বুর্জ খলিফা' অর্থাৎ কিনা 'শ্রেষ্ঠ ভবন' যেখানেই রয়েছে বিশ্বখ্যাত 'দুবাই মল'। শপিং’এর মাধ্যমে কনজ্যুমারিস্টিক প্লেজার উদযাপন করতে চান যাঁরা, দুবাই মল তাঁদের অবশ্য-গন্তব্য। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য হল খাদ্যের অফুরন্ত বৈচিত্র্য ও পৃথিবীর নানা প্রান্তের ক্যুইজিনের এভেইলেবিলিটির কথাটি। সুবিশাল জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট মার্কি হোটেলটিতে রেস্তোরাঁর সংখ্যা এই মুহূর্তে 18’টি, শীঘ্রই খুলবে ঊনিশ নম্বরটি, নাম 'ট্যাসেণ্ডা'। আমাদের জন্য ছিল 'কিচেন সিক্স' নামক রেস্তোরাঁটির বিপুল ও অতি সুস্বাদু বুফে স্প্রেড! বিলাসিতা ও শৌখিনতার মাধ্যমে নিজেদেরকে প্যাম্পার করতে চাইলে পা রাখতে হবে এই শহরে। ব্যক্তিগতভাবে বিলাসিতা ও কনজ্যুমারিস্টিক প্লেজারের চাইতে মধ্যবিত্ততার আবহটিই এখন আমার অধিক প্রিয়, তবে বৈভবের সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হওয়ার মত বেরসিকও নই। মনুষ্য সভ্যতার উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলির রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ উপভোগ করার আনন্দ কম নয়।
দুবাইয়ে ছিলাম 'জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট মার্কি' হোটেলের একান্নতলার একটি ঘরে যেখান থেকে দুবাইয়ের সৌন্দর্য যাকে বলে রাভিশিং বিউটি। আলাপ হল উত্তরবঙ্গের এক ব্যক্তির সঙ্গে যাঁর জন্ম, শিক্ষা, দীক্ষা সব শিলিগুড়ি ও দার্জিলিং’এ এবং বর্তমানে কর্মরত দুবাই শহরে। তাঁরও ভারী আক্ষেপ উত্তরবঙ্গ এত সুন্দর জায়গা হওয়া সত্ত্বেও তার রাস্তাগুলি ভালো নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে উগড়ে দিলেন ক্ষোভ। বললেন, 'দার্জিলিং’কে ভেঙ্গে কালিম্পং বানালেন কিন্তু রোড পরিকাঠামোর কাজ কিছু করলেন না'— বললাম, 'স্টেট নিজেই যদি দুষ্ট, শয়তান হয়ে ওঠে তাহলে কি হতে পারে তা দেখাচ্ছে পাকিস্তান দেশটি, আর দেখাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য’। দুবাইয়ে এসেও দুই পশ্চিমবঙ্গবাসী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে একহাত নিচ্ছেন আর তাঁদের কথোপকথন শুনে হেসে লুটিয়ে পড়ছে একজন আফ্রিকান (পশ্চিমবঙ্গবাসীর সহকর্মী)। আফ্রিকান ব্যক্তির হাসির ধরন থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গের দুরবস্থা সম্পর্কে তিনিও বিলক্ষণ অবগত। অর্থাৎ কিনা পশ্চিমবঙ্গের বিধ্বংসী অবস্থার কথা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়। ঝটিতি মনে পড়ল দিল্লির সেই ক্যাব ড্রাইভারের কথাও। 'ম্যাডাম'জী, বঙ্গাল কে লোগোঁ কো মমতা ব্যানার্জী কেয়া বহোৎ পসন্দ হ্যায়?’ এতখানি দুর্নাম এনে পশ্চিমবঙ্গকে এই মাত্রায় কুখ্যাত করে তুলতে পারার জন্যও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাপ্য হয় একখানি ধন্যবাদ। এ কাজ সবার সাধ্যানুগ নয়। দুবাইয়ের বিল্ডিংগুলি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের অনেক চুরির টাকা নিশ্চিতভাবেই ঢুকে রয়েছে এই শহরে। এ শহরে বারংবার যাতায়াত করেছেন পশ্চিমবঙ্গের একাধিক সাংসদ, বিধায়ক ও রাজনৈতিক মার্কাধারী কেউকেটা চোরেরা কারণ দুবাই শহর ফিনান্সিয়াল স্ক্যামেরও শহর। মনে পড়ল দুবাই প্রপার্টি এক্সপো আয়োজিত হয় কলকাতাতেও। সেখান থেকে কারা ইনভেস্ট করে এই শহরে?
মরুভূমির সোনালী বালির নীচে অফুরন্ত পেট্রোলিয়ামের উপস্থিতিই বলে দেয় যে আজ যেখানে অশেষ মরুভূমি, বহু প্রাচীন এক কালে (হয়ত বা কার্বনিফেরাস যুগে) সেখানে নিশ্চিতভাবেই ছিল সবুজের সমাহার, ছিলেন সুবিশাল সব বৃক্ষ মহারাজেরা। তারপর একদিন হয়ত ঘুরতে ঘুরতে, নড়তে নড়তে পৃথ্বীগোলক হঠাৎ গেল উল্টে, বৃক্ষরাজি গেল মাটির নীচে আর কালক্রমে স্থানটি পরিণত হল রুক্ষ, ঊষর এক মরুভূমিতে! লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মরুধরিত্রীর নীচে শুয়ে থেকে সেই বৃক্ষরাজেরা পরিবর্তিত হলেন পেট্রোলিয়ামে আর আরব দেশের মরুভূমির নীচে তেলের আবিষ্কার হল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ ভাগে 1908 সালে। অতঃপর ঊষর এই মরুভূমির মধ্যে ধীরে ধীরে শুরু হল বিত্তের উৎসব আর আধুনিক পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল নতুন একখানি ব্যবসা যার নাম সন্ত্রাসবাদ। এ হেন নবজাত ব্যবসাটির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা, অস্ত্রের ব্যবসাপত্তর আর সেই সঙ্গে ফুলেফেঁপে উঠতে থাকল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো। এ বৃত্তের শুরুটা বুঝি বা হয়েছিল আরব দেশের তৈল প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে, আর আজ সেই আরব দেশ তাদের তৈল ভিত্তিক বিত্তের সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বন্ধ্যা মরুভূমির মধ্যে গড়ে তুলতে চাইছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যনগরী দুবাই ও গ্লোবাল এআই হাব আবু ধাবি। মরুভূমির নিখাদ বন্ধ্যাত্বকে অতিক্রম করে শিল্প ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে চায় পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি কারণ তারা অনুভব করতে পারছে যে পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার ও প্রয়োজন কমে এবং ফুরিয়ে এলেই তাদের হাতে বিত্তের জোগান হয়ে পড়বে অপ্রতুল। তাই নিজেদের দেশের ভিন্নতর উপযোগিতা বিশ্বের দুয়ারে হাজির করতে চায় তারা। এ দূরদর্শিতা মঙ্গলজনক, যদিও প্রাকৃতিক রুক্ষতাকে হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে সার্বিকভাবে অতিক্রম করতে তারা পারবে কি না, সেকথা বলবে সময়।
পৃথিবীর বুকে একদা সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছিল যে সব দেশগুলি, তাদের পক্ষে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করার প্রকৃত প্রয়াস করা কি সম্ভব হবে? যদি হয়, তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হামাসের মত সন্ত্রাসবাদী সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বও তাদের নেওয়া উচিত। আর তা করতে গেলে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেওয়ার কাজটিও শুরু করতে হবে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিকেই। নিজেদের দেশের দরজা যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য বন্ধ করে রেখে গোটা পশ্চিম এশিয়ায় শান্তিস্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করা এবং সে উদ্দেশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া দ্বিচারিতা বলে প্রতীত হয়। তবে তার অর্থ অবশ্যই এই নয় যে দুবাই শহরের পরিকাঠামো গড়ে তোলায় কোনো কার্পণ্য তারা করেছে। কিন্তু যেহেতু সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর মত দেশগুলিতে চলে আমীরশাহী, গণতন্ত্র নয়, ফলে পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি স্থাপনের দায় প্রথমতঃ ও প্রধানতঃ এইসব সামন্ততান্ত্রিক দেশগুলির আমীর, ওমরাহদেরই। পশ্চিম এশিয়া ও গোটা বিশ্বে ইসলামীয় সন্ত্রাসবাদের অবসান হয়ে শান্তি স্থাপিত হলেই ঝাঁ চকচকে দুবাই শহরের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতে থাকবে না আর কিছুমাত্র বাধা।
গত 13ই মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সফর করেছেন কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমীরশাহীসহ পশ্চিম এশিয়ার নানা দেশে যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কাতার উপহার দিয়েছে নতুন একখানি বোয়িং 747 বিমান আর বদলে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার বোয়িং কম্প্যানি পেয়েছে কাতার এয়ারওয়েজকে 200’র বেশি বোয়িং বিমান সরবরাহ করার এক বিশাল ব্যবসায়িক চুক্তি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাষায় যা হল "the largest order of jets in the history of Boeing," ফলে প্রশ্ন জাগছেই যে হামাসের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মাথায় হাত রাখার অভিযোগ রয়েছে যে কাতারের বিরুদ্ধে, সেই কাতারের সঙ্গে কি তবে ব্যবসায়িক চুক্তির মাধ্যমেই হয়ে যাবে বোঝাপড়া? সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার বিষয়ে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ কি তবে নেওয়া হবে না আমেরিকার দিক থেকে? নাকি ব্যবসায়িক সূত্রে বাঁধার মধ্য দিয়েই হামাসকে নিয়ন্ত্রণের বার্তা কাতারকে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট?