Bhasha24 : ইতিহাসে এমন কিছু শব্দ আছে, যেগুলো শোনা মাত্রই বাঙালির ভেতরে এক অদম্য ঐশ্বরিক শক্তি জেগে ওঠে। “জয় বাংলা” হলো ঠিক তেমন'ই একটি শ্লোগান, যা কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রামী চেতনা এবং স্বাধীনতার প্রতীক। কিন্তু এই শ্লোগানের আসল উৎপত্তি কোথায় জানেন কি? কীভাবে এটি কোটি কোটি বাঙালির প্রাণের স্লোগানে পরিণত হলো? আজ তা নিয়েই আলোচনা করবো।
বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো ১৯৪৮ সাল থেকে। ধীরে ধীরে আন্দোলন প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এসে তা এক ঐতিহাসিক রূপ নেয়। ভাষা আন্দোলন করতে যখন তরুণরা রাস্তায় নামলেন, তখন তাদের মুখে উচ্চারিত হতে থাকে বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান। ঠিক এই সময় থেকেই “জয় বাংলা” ধীরে ধীরে ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে বিশেষ ভাবে পরিচিতি লাভ করে। যদিও তখনও এটি খুব প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহৃত হয়নি, তবে স্বাধীনতার আগুন জ্বালানোর বীজ বপন হয়েছিল সেই সময়েই।
“জয় বাংলা” প্রথম সর্বোচ্চ ভাবে উচ্চারিত হয় ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময়। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বিশেষ করে সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি রা এই জয় বাংলা শ্লোগানকে আন্দোলনের প্রধান শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। সেদিন রাস্তায় নেমে যারা শ্লোগান দিয়েছিলেন, তাদের কণ্ঠে “জয় বাংলা” হয়ে ওঠে এক অন্য রকম বিদ্রোহের আহবান।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তখন পূর্ব বঙ্গের মানুষ স্বপ্ন দেখছিল নিজেদের ভাগ্য বদলানোর। সেই সময় নির্বাচনী প্রচারণায় “জয় বাংলা” কে সর্বপ্রথম মূল শ্লোগান হিসেবে সামনে আনা হয়। গ্রামের ছোটো ছোটো হাট বাজার থেকে শুরু করে শহরের চা দোকান সব জায়গায় একযোগে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে একই স্লোগান “জয় বাংলা”।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন প্রবল ভাবে ভয়াবহ আকার ধারণ করলো, তখন এই “জয় বাংলা” শুধু স্লোগান নয়, সমস্ত মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধের শপথ হয়ে দাঁড়ায় এই শ্লোগান। মুক্তি যোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যাওয়ার আগে একে অপরকে “জয় বাংলা” বলে নিজের মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। এই শ্লোগান যেনো তাদের মনে এক ধরনের অলৌকিক সাহসের সঞ্চার করতো। যুদ্ধের সময় এই শ্লোগান হয়ে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান শক্তি।
১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বক্তৃতা শেষ করলেন, এবং তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” এই উচ্চারণ মুহূর্তেই কোটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেলো, এবং পরক্ষনেই এরপর থেকেই “জয় বাংলা” হয়ে উঠলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও “জয় বাংলা” তার শক্তি হারায়নি। এটি হয়ে ওঠে মুক্তি যুদ্ধের চেতনা বহন কারী স্লোগান। পরবর্তী কালে রাজনৈতিক পালাবদলে এর ব্যবহার কখনও কমেছে, তো কখনও আবার বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই শ্লোগান টি চিরকাল যেনো এক অটল শক্তির প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে আপামর সমস্ত বাংলাদেশীর হৃদয়ে।
২০১৯ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশ হাইকোর্ট রায় দেন যে এই “জয় বাংলা” হবে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের মতে, এই শ্লোগান টি কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের নয়, পুরো জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। বাংলাদেশী রা মনে করেন যে এই শ্লোগানের মাধ্যমে একদিকে যেমন স্বাধীনতার ইতিহাসকে তারা একাত্ম চিত্তে তারা স্মরণ করে, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মকেও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম তো মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি দেখেনি, কিন্তু তারা জানে যে একটি স্লোগান কীভাবে একটি জাতিকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাই যখনই “জয় বাংলা” বলা হয়, তখনই মনে পড়ে যায় সেই অসংখ্য শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদের কথা, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাই “জয় বাংলা” কেবল একটি অতীত নয়, এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্যও এক দেশপ্রেমের প্রেরণার উৎস।
“জয় বাংলা”র উৎপত্তি ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে, এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে এর সংগঠিত ব্যপক ব্যবহার শুরু হয়, এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এটি বাঙালি জাতির জাতীয় চেতনার এক স্থায়ী প্রতীক হয়ে ওঠে। ইতিহাসের পাতায় এই দুটি শব্দ আজ শুধু একটি শ্লোগান নয়, বরং এটি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের হৃদয়ের জাতীয় ধ্বনি।